প্রকাশিত হয়েছেঃ শুক্রবার, ১২ই জুন ২০২০
করোনার নির্মম থাবা থেকে কেউ রক্ষা পাচ্ছে না। ধনী, দরিদ্র, ফকির বাদশা সবাই এর শিকার। কারো রক্ত চক্ষুকে সে পরোয়া করেনা। রাজপ্রসাদের সর্বোচ্চ শক্তিধর ব্যক্তিটি থেকে শুরু করে কুড়ে ঘরে বসবাসরত তুচ্ছ ক্ষমতা সম্পন্ন ব্যক্তিটি পর্যন্ত কেউই তার কাছে আলাদা নয়।

সবাই তার চোখে সমান। করোনা নামক মানুষ খেকো এ জীবাণুটির প্রতি নিঃসন্দেহাতীত ভাবে ঘৃণা লুকিয়ে থাকলেও এর এ সাম্যনীতি আমার বেশ পছন্দের। আহা! আশরাফুল মাখলুকাত যদি করোনার এ নীতিটাকে লুফে নিতে পারতো পৃথিবীটা কতোইনা সুন্দর হতো!

করোনার সাম্যবাদ নীতির কাছে সবাইকে পরাস্ত হতে হচ্ছে। কানাডার প্রধানমন্ত্রী দম্পতি থেকে শুরু করে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন, অস্ট্রেলিয়ার সরাষ্ট্রমন্ত্রী পিটার ডুটন ফ্রান্সের এক সাবেক মন্ত্রী সহ বিশ্বের অনেক ক্ষমতাশালী ব্যক্তিকেই করোনা কাবু করেছে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট এখন পর্যন্ত করোনার প্রত্যক্ষ হামলা থেকে রক্ষা পেলেও তিনিও খুব একটা নিরাপদে নেই। হোয়াইট হাউজের অন্দরমহলে ইতোমধ্যে করোনা ঢুকে গেছে। সেখানকার কিছু ষ্টাফ আক্রান্ত। তাই যে কোনো সময় মি ট্রাম্পের উপর করোনা তার বিষদাত বসিয়ে দিতে পারে। যদিও আমার প্রার্থনা, এমনটি যেনো না ঘটে।

করোনার এ নীতিবোধ থেকে বাংলাদেশও বাদ পড়েনি। ধনী গরিবের পাশাপাশি অনেক হাই প্রোফাইল সম্পন্ন ব্যক্তিবর্গও করোনার মরণ কামড় থেকে রেহাই পাচ্ছেনা। হাসপাতালের বেডে শুয়ে শুয়ে করোনার সাথে তারা যুদ্ধ করে চলছে। এদের মধ্যে গনস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা জনাব জাফরুল্লাহ চৌধুরী, সাবেক সরাষ্ট্র ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং, সিলেটের সাবেক মেয়র কামরান সহ অনেকেই রয়েছেন। করোনা যে গতিতে এগোচ্ছে তা কোনো এক সময়ে গনভবনে গিয়ে যে পা ফেলবেনা তা আমরা কেউই হলফ করে বলতে পারিনা।

আমার প্রশ্ন হচ্ছে, কেনো আজ এ পরিস্থিতি? কেনো করোনা বাংলাদেশে বহাল তবিয়তে রাজত্ব করার সুযোগ পেলো? কে বা কারা এ অবস্থার জন্য দায়ী? এর উত্তর খুঁজতে গেলে কিছু অপ্রিয় সত্য কথা চলে আসে।

করোনা যখন বাংলাদেশে ধেয়ে আসছিলো ঠিক তখন যদি কর্তা ব্যক্তিরা অনবরত কান্ডজ্ঞানহীন বক্তব্য না দিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন তাহলে দেশে করোনার অবস্থান এতোটা ভয়ানক হতোনা। বিদেশ থেকে যেসব যাত্রীরা দেশে গিয়েছিলেন তাদেরকে সাদামাটা ভাবে কোয়ারেন্টাইনে না রেখে যদি প্রকৃত ভাবেই সুরক্ষিত রাখা যেতো তাহলে প্রথমেই করোনার হাত থেকে দেশ রক্ষা পেতো। এতে যদি সরকারের কোটি টাকাও ব্যয় হতো তাও দেশ বেঁচে যেতো। এতো প্রাণহানি ঘটতোনা। লকডাউনের মাধ্যমে যে হাজার হাজার কোটি টাকা গচ্ছা দিতে হয়েছে তা থেকেও রক্ষা পাওয়া যেতো।

পরবর্তীতে দেশে লকডাউন জারি করা হলেও সরকারের নড়বড়ে কৌশল ও উদার নীতি, গার্মেন্টস মালিকদের বালখিল্যতা, ঈদের আগে ও পরে যানবাহন বোঝাই করে গাদাগাদি করে যাত্রীদের বাড়ি যাওয়া ও ঢাকায় ফেরা, স্বাস্থ্য বিধি মেনে না চলা, সর্বোপরি অশিক্ষা, অজ্ঞতা ও ক্ষুধা প্রভৃতি কারণে লকডাউন ব্যর্থ হয়। ফলে করোনার প্রকোপ দেশে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। করোনার অবস্থান যখন তুঙ্গে এমন একটা অবস্থায় সরকার লকডাউন তুলে দেয়। ফলশ্রুতিতে অবস্থা আরও ভয়ানক রূপ ধারণ করে। প্রতিদিন হাজার হাজার লোক আক্রান্ত হচ্ছে ও মৃতের সংখ্যাও বাড়ছে।

অবস্থা বেগতিক দেখে সরকার আবারও লকডাউন পুনর্বহালের সিদ্ধান্ত নেয়। তবে এবার তা ভিন্ন পদ্ধতিতে কার্যকর করার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ দেশের করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে বিভিন্ন এলাকাকে রেড, ইয়েলো ও গ্রিন বা লাল, হলুদ ও সবুজ - এই তিন ভাগে ভাগ করে জোন ভিত্তিক লকডাউন করার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। নিঃসন্দেহে এটি একটি ভালো উদ্যোগ। কিন্তু এ লকডাউন যেনো আগের মতো বিফল না হয়ে যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সেক্ষেত্রে সরকারের উদারনীতি প্রত্যাহারের সাথে সাথে প্রশাসনের ভূমিকা আরও জোরালো ও কঠোর হতে হবে এবং সাধারণ জনগণকে সচেতন করে তোলার জন্য দল মত নির্বিশেষে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

আরেকটি যে বিষয় উল্লেখ করা খুবই জরুরি তা হলো, সরকারের সীমাবদ্ধতা, ব্যর্থতা যাই থাকুক না কেন, যে যাই বলি বা সমালোচনা করিনা কেনো কিংবা সরকারি দলে চোর, টাউট, বাটপার, চামচা যাই থাকুক না কেনো দেশ পরিচালনা বা এর হাল ধরে রাখার ক্ষেত্রে এ মূহুর্তে শেখ হাসিনার চেয়ে অধিকতর যোগ্য নেতা বা শাসক আছে বলে আমার মনে হয়না। তাঁর বিকল্প কেবল তিনি নিজেই। তাই গনভবন যাতে করোনা হামলার শিকার না হয় সে দিকটি বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে। হোয়াইট হাউজ, ১০ ডাউনিংস্ট্রিট ইতোমধ্যে করোনার শিকারে পরিণত হয়েছে। আমরা জানি আমাদের প্রধানমন্ত্রী বেশ সাহসী। তিনি মৃত্যুকে ভয় করেননা। গতকালও সংসদে তিনি ধ্যার্ত কন্ঠে তা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, "করোনাভাইরাসে মরি, গুলি খেয়ে মরি, অসুস্থ হয়ে মরি, মরতে একদিন হবেই। এই মৃত্যু যখন অবধারিত সেটাতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি ভয় পাইনি।"

তিনি ভয় পান বা না পান সেটা বড়ো কথা নয়। দেশ ও জাতির স্বার্থেই তাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। জানি, হায়াত মউত আল্লাহর হাতে। কিন্তু সাবধান ও সতর্ক থাকতেও আল্লাহ্ নির্দেশ দিয়েছেন। তাই গনভবনকে করোনামুক্ত রাখা এখন সময়ের দাবি। দেশ বিদেশ থেকে আগত করোনা সন্দেহভাজন কেউ যেনো গনভবনে ঢুকতে না পারে সে ব্যাপারে কর্তব্যরত ব্যক্তিদের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। পক্ষান্তরে, যারা প্রধানমন্ত্রীর নেক দৃষ্টির আশায় গনভবনে ভিড় জমান তাদেরকে আরও বেশি সচেতন, বিবেকবান ও দায়িত্বশীল হতে হবে। করোনার প্রারম্ভিক কালে যুক্তরাজ্য থেকে দেশে ফিরেই সিলেটের প্রাক্তন মেয়র প্রধানমন্ত্রীর সাথে সৌজন্য সাক্ষাত করতে গিয়েছিলেন। এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেনো না ঘটে সে ব্যাপারে অবশ্যই দায়িত্বশীলরা কার্যকরী ভূমিকা পালন করবেন। মোট কথা, গনভবনকে করোনা হামলা থেকে বাঁচাতে সংশ্লিষ্ট সবাই সচেষ্ট থাকবেন সেটাই প্রত্যাশা।

সাজেদুল চৌধুরী রুবেল
লেখক, প্রাবন্ধিক ও বিশিষ্ট কলামিস্ট
লিমরিক, আয়ারল্যান্ড
ইমেইলঃ এই ইমেইল ঠিকানাটি spambots থেকে রক্ষা করা হচ্ছে। এটি দেখতে হলে আপনার জাভা স্ক্রিপ্ট সক্রিয় থাকতে হবে।